শিক্ষাক্রমের ধারণার বিবর্তণ

শিক্ষাক্রমের একক কোন সর্বজনস্বীকৃত সংজ্ঞা পাওয়া যায় না। বিভিন্ন মানুষ তার ভিন্ন ভিন্ন প্রয়োজনে শিক্ষাক্রমের নানা সংজ্ঞা প্রদান করে থাকেন। সে সব সংজ্ঞা কেবল সে সব মানুষের প্রয়োজন মিটাতেই কর্যকর ভূমিকা পালন করে। সে সব সংজ্ঞা দ্বারা তাদের মূল্যবোধ ও অভিজ্ঞতা প্রকাশ পায়।
একজন শিক্ষার্থী কি পড়বে, কে পড়াবে, কোথায় পড়বে, কতদিন পড়বে, কিভাবে পড়বে, শিখন সামগ্রী কিরূপ হবে, কি ধরণের শিক্ষা উপকরণ ব্যবহার করতে হবে ইত্যাদি নির্দেশনার সমষ্টিতে শিক্ষাক্রম প্রণীত হয়। একটি শিক্ষাস্তর সমাপ্ত করে একজন শিক্ষার্থীর জ্ঞান, দক্ষতা, দৃষ্টিভঙ্গি ও আচরণীক স্তর কি হবে তা পূর্বেই নির্ধারিত করে নিতে হয়। এ সব কিছুই শিক্ষাক্রমের অন্তর্গত।
সাধারণ ভাবে বলা যায়, “শিক্ষাক্রম হল সুনির্দিষ্ট কয়েকটি লক্ষ্যের ভিত্তিতে প্রণীত শিখন অভিজ্ঞতা, পঠন-পাঠন সামগ্রী এবং শিক্ষাদান কার্যাবলির সমন্বিত রূপ্রেখা যার মাধ্যমে শিক্ষার্থীর জ্ঞান, দক্ষতা ও দৃষ্টিভঙ্গির সামাজিক ভাবে গ্রহণযোগ্য ও বাঞ্চিত পরিবর্তন আনার মাধ্যমে শিক্ষার পূর্বনির্ধারিত লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য অর্জিত হয়”।


শিক্ষাক্রমের ধারণা কি?
শিক্ষাক্রম শিক্ষাব্যবস্থার প্রাণ। শিক্ষাক্রম হল শিক্ষাব্যবস্থার সামগ্রিক রূপরেখা। শিক্ষাক্রম শব্দটির উৎপত্তি নিয়ে কিছু মতোভেদ রয়েছে। কেউ কেউ বলেন, “Curriculum” শব্দটি ল্যাটিন শব্দ “Currere” থেকে উদ্ভুত হয়েছে। “Currere” শব্দটি প্রাচীন রোমে ব্যবহৃত হত যার অর্থ “Course of Study”, আবার কারো কারো মতে, “Curriculum” শব্দটির উদ্ভব ল্যাটিন শব্দ “Currer” থেকে যার অর্থ “ঘোড়া দৌঁড়ের পথ” আভিধানিক অর্থে “Curriculum” হল “নির্দিষ্ট লক্ষ্যে উপনীত হওয়ার জন্য একটি কোর্স বা “A course to be run for reaching certain goal”।
বিগত কয়েক দশক থেকে লক্ষ্য করা যাচ্ছে যে শিক্ষাক্রম কথাটি শিক্ষাবিদগণ নানা অর্থে ব্যবহার করছেন। ফলে এর সুনির্দিষ্ট কোন সংজ্ঞা প্রদান করা খুবই কষ্টসাধ্য। শিক্ষাক্রমের নানা বিশেষজ্ঞদের সংজ্ঞায় যেমন মিল রয়েছে তেমনই কোথাও কোথাও আবার লক্ষ্য করা গিয়েছে ব্যাপক অমিল। এই মিল অমিলের ভিড়ে শিক্ষাক্রমের পৃথক কোন অস্তিস্ব পাওয়া সহজ ব্যাপার নয়।
শিক্ষাক্রমকে তুলনা করা যেতে পারে শিক্ষা ব্যবস্থার একটি নীল নকশা হিসেবে। একজন প্রকৌশলীর জন্য যেমন নীল নকশা ছাড়া কোন স্থাপনা দাঁড় করানো সম্ভব নয় ঠিক তেমনি, শিক্ষাক্রম ছাড়া শিক্ষা ব্যবস্থাকে দাঁড় করানো যায় না। শিক্ষার সাথে জড়িত যাবতীয় কার্যাবলি শিক্ষাক্রমের অন্তর্গত।

শিক্ষাক্রমের ধারণা যে কাজে ব্যবহৃত হয়
জাতীয় চাহিদার ভিত্তিতেই একটি দেশে শিক্ষাক্রম গড়ে ওঠে। আর জাতীয় চাহিদার মূলে থাকে জাতীয় জীবন দর্শন। সুতরাং বলা যায় যে, একটি জাতির জীবন দর্শনের মধ্যেই সে জাতির শিক্ষা ব্যবস্থার বিভিন্ন স্তরের শিক্ষাক্রমের কাঠামো ও প্রকৃতি নিহিত থাকে।
একটি দেশের শিক্ষাক্রম ও এর কাঠামো যে সব বিষয়ের উপর নির্ভর করে গড়ে ওঠে সেগুলো হল-
• জাতীয় দর্শন
• রাষ্ট্রীয় আদর্শ
• অর্থনৈঈতিক অবকাঠামোগত অবস্থা
• সামাজিক অবকাঠামোগত অবস্থা
• জাতীয় ঐতিহ্য
• জাতীয় ইতিহাস
• জাতিগত মূল্যবোধ
• জনগণের ধর্মীয় চেতনা ও বিশ্বাস
• সামাজিক পরিপ্রেক্ষিত
• সাংস্কৃতিক পরিপ্রেক্ষিত
• জনগণের সমকালীন জীবনব্যবস্থা
• দেশের প্রচলিত শিক্ষাব্যাবস্থা
• বস্তুগত সম্পদের প্রাপ্যতা
• শিক্ষার্থীর সমকালীন চাহিদা
• শিক্ষার্থীদের ভবিষ্যৎ চাহিদা
• সমাজের সার্বিক উন্নয়ন কর্মকান্ড
• সমাজের জরুরী চাহিদা
• ভবিষ্যৎ সমাজ নির্মাণে বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি ব্যবহারের রূপরেখা ইত্যাদি।
বিশেষ কোন কারণে লক্ষ্য করা যায় যে শিক্ষাক্রমের অতীত অবস্থা নিয়ে তেমন কোন লেখা বা বই পাওয়া যায় না। শিক্ষাক্রম বিশেষজ্ঞগণ ও শিক্ষাক্রম গবেষকগণ নোন এক অজ্ঞাত কারণে শিক্ষাক্রমের অতীত অবস্থা নিয়ে তেমন কিছু লিখে যাননি।
তবে এ কথা সত্য যে অনেক প্রাচীনকাল থেকেই শিক্ষাক্রমের ধারনাটি প্রচলিত। স্কটল্যান্ডে সপ্তদশ শতাব্দি থেকেই শিক্ষাক্রম শব্দটির বহুল ব্যবহার রয়েছে বলে জানা যায়।
তবে শিক্ষাক্রম নিয়ে সবচেয়ে বেশি আলোড়ন সৃষ্টি হয় মূলত আমেরিকায়। সেখানে আধুনিক কালের মত শিক্ষাক্রমের বহুল ব্যবহার দেখা যায় ১৮২০ সাল থেকেই। তবে তখনও শিক্ষাক্রমের ধারনা ততটা সংকীর্ণতামুক্ত হতে পারেনি। তখন শিক্ষাক্রম বলতে বোঝান হত “Course of Study” কে। শিক্ষাক্রমকে পাঠ্যপুস্তকের বিষয়বস্তু, কোর্স সীমারেখা, শিক্ষক নির্দেশিকা বা Product হিসেবে দেখা হত। এই ধারনায় শিক্ষাক্রমের ব্যাপক ব্যবহার দেখা যায় ১৯৩০ সাল পর্যন্ত। এসময় শিক্ষকগণ শিক্ষাক্রমকে পাঠ্যবিষয়ের তালিকা হিসেবে নির্দিষ্ট সময় পর পর শ্রেণীতে পাঠদানের জন্য ব্যবহার করতেন এবং শিক্ষার্থীরা তা গ্রহন করতো।
প্রাচীনকালে জ্ঞান আহরণ করাই ছিল শিক্ষার মূল লক্ষ্য। এজন্য শিক্ষাক্রমে সুসংবদ্ধ জ্ঞান ও মানসিক শৃঙ্গলার ওপর বিশেষ গুরুত্ব আরোপ করা হত। তখন শিক্ষাবিদদের ধারনা ছিল যে এমন কিছু অপরিহার্য বিষয় রয়েছে যেগুলো আয়ত্ত করতে পারলেই শিশুর পরিপূর্ণ মানসিক বিকাশ হবে। এই ধারনা থেকে শিক্ষাবিদগণ বিদ্যালয়ের শিক্ষাক্রমে কতগুলো স্থায়ী ও অপরিহার্য পাঠ্যবিষয় অন্তর্ভূক্ত করার প্রস্তাব দেন।

admin

I am simple

Post a Comment

Previous Post Next Post